Erotica প্রথম কদমফুল

Newbie
2
0
1
প্রথম কদমফুল


রাত প্রায় এগারোটা। নিশুতি না হলেও রজনী আর নেহাত শিশু নয়, গুটিগুটি পায়ে ক্রমেই প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে ওঠার পথে। কলকাতা শহরের মধ্যবিত্তপাড়ার অধিকাংশ বাড়িগুলোতে এসময়ে সিরিয়াল বা পারিবারিক গেম-শো শেষ হওয়ার পর ডিনারের এঁটোকাঁটা তোলার তোড়জোড় আর ব্যস্ততা। রাত্রিকালীন সুষুপ্তি কিংবা রতিক্রীড়ার প্রাক্প্রস্তুতি।
ব্যতিক্রম কেবল আমাদের বাড়ি।
ঘরে-ঘরে জ্বলছে জোরালো ওয়াটের আলো, সঙ্গে ভেসে আসা মৃদু গুঞ্জন। খাওয়া-দাওয়ার পাট এখনও চোকেনি পুরোপুরি। ঘড়ির কাঁটা বারোর দিকে ছোটার সাথে জারি হওয়া নীরবতার অলিখিত ফরমানকে নস্যাৎ করে নারীকণ্ঠেরা বেজে উঠল জলতরঙ্গ হয়ে।
সকলেই ব্যতিব্যস্ত, আমি বাদে। কালকের বিবাহবাসর আর আগামীর ফুলশয্যার মাঝে আজকের দিনটা বিশ্রাম।
আজ আমার কালরাত্রিযাপন।
জানলার বাইরে কদমগাছটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। মৃদুমন্দ দখিনাবাতাসের সাথে মন ছুটে চলেছে বহুবছর আগের সেই রাত্রে।




এক প্রজাতির ছাত্র সর্বদেশে সর্বকালে থাকে যাদের কাজ স্কুলের পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রথম নাহোক দ্বিতীয় স্থানটি অধিকার করা, একইসাথে সমান্তরাল পৃথিবীর হালহকিকত সম্বন্ধে চূড়ান্তভাবে অজ্ঞ থেকে ক্লাসের অন্যান্যদের আমোদ জোগানো। প্রকৃতির বাকি সব নিয়মেরমত এরও ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের ক্লাসে গুটিকয় যেক’জন এই গুরুদায়িত্ব স্কুলের একেবারে শুরুর দিনটি থেকে কলেজের চৌকাঠে পা রাখা পর্যন্ত নিষ্ঠাভরে পালন করে গেছে, আমি ছিলাম তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। হেন বিষয় ছিলনা যেটাতে আমার অনভিজ্ঞতা বাকিদের খোরাকের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেনি। অকালপক্ব সহপাঠীদের বাছাইকরা বিশেষণের সিংহভাগ বরাবর নিজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে এসেছি। মনের গভীরপ্রদেশে এজন্য দুঃখের অবধি ছিলনা, অবশ্য সেটা জানত শুধু খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু।
যাহোক বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে, পরীক্ষার খাতায় সেসব উগরে দিয়ে, স্যারেদের বাহবা আর বন্ধুদের সম্ভ্রমমিশ্রিত ঈর্ষায় অভ্যস্ত হতে হতে স্কুলজীবনের শেষ ধাপটাও একদিন পেরিয়ে গেলাম। অতঃপর কলেজ নামক বহুশ্রুত ‘সবপেয়েছির দেশে’ পদার্পণ করার পালা। তারই মানসিক প্রস্তুতি চলছিল জোরকদমে। সত্যি বলতে মনের মধ্যে কৌতূহল আর উত্তেজনার চাইতে ভয়ের ভাগটাই ছিল বেশি। শিশুকাল থেকে আমায় বড় করা হয়েছে ইংরাজি প্রবাদের ‘জ্যাক’এর অনুপ্রেরণায়। আর ‘ডাল বয়’রা যে কলেজের দাদাদের র*্যাগিংয়ের সবচেয়ে সহজ নিশানা একথা সর্বজনবিদিত। মেধাতালিকার স্থান বা জয়েণ্টএণ্ট্রান্সের র*্যাঙ্ক দেখালে উলটে বিপত্তির সম্ভাবনা, এ বোঝাপড়ায় চাই ‘এক্সট্রাকারিক্যুলার অ্যাক্টিভিটিজ’।
অথচ আমার সে ভাঁড়ার যে ঢুঁ-ঢুঁ! গান-কবিতা কোনোকালেই আসেনা। স্কুলের নাটকে মৃত সৈনিকের ভূমিকাতে নামতে পারিনি, মায়ের বারণের চোটে। খেলাধূলা? হাঃ! সেখানেও মাতৃদেবীর ঘোর আপত্তি। বাড়ির অনতিদূরেই বিশাল মাঠ, বিকেল হওয়ামাত্র যেখানে হরেকরকমের খেলার আয়োজন। রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত করুণচোখে। যেন নির্বাক ভাষায় কৈফিয়ত চাইত কোন অপরাধে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। দুর্বল সাহসে ভর করে কয়েকবার যে খেলতে যাওয়ার অনুমতি চাইনি তা নয়, কিন্তু জবাবে নীরব শীতল চাহনির সামনে কুঁকড়ে যেতে হয়েছে। অব্যক্ত কান্না বুকে চেপে প্রতিবার বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে আসাই ছিল নিয়ম। একসময় বায়না থেমে গেল আপনা থেকেই। মেনে নিয়েছিলাম নিজের ভবিতব্যকে। অবশ্য মায়ের যুক্তি ছিল খুবই সরল এবং প্রাঞ্জলঃ যেকাজে আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, বড় হয়ে যেটায় গ্রাসাচ্ছাদনের চাহিদা মিটবে না, সেসমস্ত ‘অকাজ’এ অযথা সময় নষ্ট করার চেয়ে পড়াশোনায় মন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। অবাক লাগত ভাবলে যে এই ভদ্রমহিলাই বিএসসিতে ফার্স্টক্লাস সেকেণ্ড হওয়ার চাইতে বেশি প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন কোকিলকণ্ঠী নামে। কলেজসোশ্যালে মায়ের সঙ্গীতপরিবেশনা ছিল বৃহত্তম আকর্ষণ! পরবর্তীতে যদিও স্বামীর পরিচর্যা, গৃহস্থালীর দেখভাল আর ছেলেকে শাসনে রাখাই অষ্টপ্রহরের ‘ফুলটাইম জব’। ‘এত লেখাপড়া করে তোমার কোন কাজে লাগল’ - সেই প্রশ্ন বারকয়েক মনে জাগলেও মুখ ফুটে বেরোনোর ধৃষ্টতা দেখায়নি, সঙ্গত কারণেই। অগত্যা বই-খাতা-স্কুল-এগজাম-টিউটোরিয়াল নিয়েই ছিল আমার বয়ঃসন্ধির একলা জগত।
তবে ঊষর মরুতেও ফুল ফোটে, গড়ে ওঠে মরুদ্যান। আমার নিরানন্দ কৈশোরের বদ্ধ চিলেকোঠায় একঝলক দমকা বাতাসের মত ছিল অতীশকাকু, বাবার অফিসের জুনিয়র কলিগ। থাকত আমাদের পুরনো এই পাড়ার মাইলখানেকের মধ্যেই। গানে-গল্পে আসর মাতিয়ে তুলতে অদ্বিতীয়, অন্যদিকে তুখোড় মাউণ্টেনিয়ার। ফি বছর বেরিয়ে পড়ত হিমালয়ের দিকে, বিভিন্ন সব গিরিশৃঙ্গ জয় করতে, যাদের সাথে আমার পরিচয় কেবল ভূগোলবইয়ের পাতায়। কয়েকবছর অন্তর ইউরোপ-আফ্রিকাযাত্রাও ছিল রুটিনের মধ্যে। কাকু বলে ডাকতাম, তবে বাবার অনেকটাই জুনিয়র, হয়তো আমার থেকে বছর বারো-তেরো বেশি। পিছুটান বলতে ছিল শুধু নিজের এক ভাই। তখনও বিয়ে করেনি, ঝাড়া হাতপা। যেকোনও জমায়েতের নয়নের মণি, সবাই অতীশ বলতে অজ্ঞান। আমাদের বাড়িতেও তার অবারিত দ্বার। মাঝেমাঝেই ছটফটিয়ে চলে আসত পাগলা তুফানের মত। আসামাত্র ঝোলা থেকে বেরোত আমাদের জন্য দেশবিদেশ থেকে আনা হরেকরকম জিনিষ। বাবা মা অনুযোগ করলেই হা-হা করে পাড়কাঁপানো দিলখোলা হাসি। এমন মানুষকে ভাল না বেসে উপায় নেই।
তার সাথে আমার ছিল অসমবয়সী এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। রবিঠাকুর বলেছেন বটে, ‘ত্রিশ বৎসরের যুবক বিশবর্ষীয়কে করুণার চক্ষে দেখে’, কিন্তু অতীশকাকুকে দেখলে উনিও বোধহয় মত পালটাতেন। আট থেকে আশি সকলের যে নয়নের মণি, তার জন্য বুঝি ব্যতিক্রমটাই নিয়ম! অতীশকাকু আসা মানে আমারও আহ্লাদে আটখানা দশা, অন্তত পড়াশোনার একঘেয়েমি থেকে সাময়িক বিরতি। বই মুখে বসে আছি দেখলেই কাকু রেগে যেত, বলত ‘ফুটবল খেল, জানিস না স্বামীজি কি বলেছেন?’ তা স্বামীজি কি বলেছেন সেটা জানার আমার তর সইত না, বইপত্র মুড়ে বসে যেতাম কাকুর নতুন অ্যাডভেঞ্চারের গল্প গোগ্রাসে গিলতে। এই একটা জায়গায় মায়ের অনুমতির তোয়াক্কা করতাম না, কাকু এলে তার কাছে মায়ের ক্ষীণ আপত্তিও যে ধোপে টিকবে না সেটা বিলক্ষণ জানা ছিল। আর একবার কাকু গল্প শুরু করলে সময় যে কোথা দিয়ে বয়ে যেত সেদিকে কারোর হুঁশ থাকতনা- না কথকের, না শ্রোতার। বেসক্যাম্পের সূচনা থেকে পর্বতের বিপদসঙ্কুল চড়াই বেয়ে, বিপজ্জনক সব গিরিখাতকে অতিসাবধানে পাশ কাটিয়ে গল্প যতই তুষারাচ্ছাদিত চূড়ার দিকে এগিয়ে যেত, আমার হৃদস্পন্দনের গতি ততই বেড়ে উঠত, শরীরের সমস্ত রোমকূপ শিহরিত হত উত্তেজনায়। নৈশভোজের জন্য মায়ের আহ্বানকে বারংবার উপেক্ষা করে গল্পে মেতে থাকতাম দু’জন, যতক্ষণ না আরোহীর পা আবার সমতলের মাটিতে নেমে আসে। সে আশ্চর্য রোমাঞ্চের কাছে আমার চার দেওয়ালের এই বর্ণহীন জীবনকে মনে হত নিতান্তই তুচ্ছ।

সেদিনটা ছিল জুনমাসের শেষদিকের কোনও তারিখ। একেএকে বেরোচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার রেজাল্ট, বাড়িতে তাই খুশির হাওয়া। ছেলের সামনে উজ্জ্বল কেরিয়ারের সোনালি হাতছানির হদিশ পেয়ে বাবা খুশিতে ডগমগ, মায়ের মুখেও শাসনের রেখাগুলো ঈষৎ কোমল। প্রায়শই কোনও না কোনও ছুতোয় ভালমন্দ রান্না হচ্ছে, সাথে লেগে রয়েছে শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়স্বজনদের আনাগোনা। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে কুড়িয়ে পাওয়া মাসকয়েকের অলস অবসরে আমিও ধীরে ধীরে হাঁফিয়ে উঠছি। প্রথমদিকটায় ভাল লাগলেও এখন যেন আয়েশি কর্মহীনতার একঘেয়েমি বুকের উপরে জগদ্দলপাষাণের মত চেপে বসছে। বাড়িতে থেকে গল্পের বই পড়া আর মাসান্তে বন্ধুদের সাথে একটা-দু’টো সিনেমা, এই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার রুটিন। আগেকার সেই স্কুল-টিউশন-সিলেবাস-টেনশনের ব্যস্ত রোজনামচাকেই সময় সময় উপাদেয় মনে হচ্ছে। যেন সোনার খাঁচায় সোনার শিকলে বন্দি পাখি।
ভরা আষাঢ়, সন্ধে নামার মুখে আকাশে কালো মেঘেদের যাতায়াতে আগাম পূর্বাভাস- রাত্রে তারা কি ভয়ঙ্কর চেহারা নেবে! চতুর্দিক শান্ত-স্তব্ধ, বাতাসে একটা অস্থির দমচাপা ভাব। প্রলয়ঙ্করী প্রকৃতি তার স্বরূপ ব্যক্ত করার আগে সবাইকে সময় দিচ্ছে নিরাপদ গৃহকোণে আশ্রয় নেওয়ার। রাস্তার আলোগুলো আজ অসময়ে জ্বলে উঠেছে বিপদের সঙ্কেত পেয়ে। পথঘাট দ্রুতই ফাঁকা হচ্ছে, বেশিক্ষণ ঘরের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। দক্ষিণের দিকে আমার একটেরে ঘরের ছোট্ট একফালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, সহসা বাড়ির সদরের দিকে দৃষ্টি যেতেই আনন্দে মন উদ্বেল। অতীশকাকু! প্রায় মাসখানেকের পর।
একদৌড়ে নীচে নেমে গেছি দরজা খুলতে। কাকু আজই ফিরেছে সুমাত্রায় ট্রেকিং করে, সদর থেকে দোতলার ড্রয়িংরুমে আসতে না আসতেই সে অভিযানের গল্প প্রায় মাঝপথে। ওদিকে মা ক্রমাগত বকছে, ‘ছাড় ছাড়, কাকুকে একটু জিরোতে দে! পরে গল্প শুনিস’... কিন্তু আজ আমায় পায় কে! এতদিন পরে কাকুকে পেয়েছি, এখন তো দেদার আড্ডা আর মজা। বসামাত্র বিচিত্রদর্শন ঝোলা থেকে একে একে বেরোচ্ছে রকমারি উপহার- বাবার বহুদিনের শখ বাহারি অ্যাশট্রে, মায়ের জন্যে রঙিন পাথরের গয়না আর আমার দিকে এগিয়ে এল হলদেটে রঙের কি এক অদ্ভুত যন্ত্র। জানলাম ওখানকার কোনও পাহাড়ে সম্প্রতি খননকার্যের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর অতিকায় কঙ্কাল, বাঁকাপথে তার কিছুটা অংশ নাকি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল চোরাবাজারে। তারই একটা হাড় থেকে বানানো এই বাঁশি, লোকাল কোনও কিউরিও শপে বহু সাধ্যসাধনায় জোগাড় করা। নিখুঁত কারিগরি আর নৈপুণ্যে বানানো সেই বাঁশির সাউণ্ড টেস্টিংএর মাঝে বাবা এসে উপস্থিত, কাকভেজা। ঘরের মধ্যে থাকার জন্যই হোক বা কাকুর আসার উত্তেজনায়, টের পাইনি কখন বাইরের বৃষ্টিটা আরম্ভ হয়ে এখন মুষলধারে চরাচর ভাসাচ্ছে। বাবার কথায় জানলাম সামনে বড়রাস্তার গলির মুখ থেকে জল জমতে শুরু করে দিয়েছে, এখন সবে গোড়ালি ডুবলেও এই হারে বর্ষণ চলতে থাকলে অবিলম্বে হাঁটু বা কোমরে উঠে আসতে পারে। মিনিটখানেকের মধ্যেই স্থির হয়ে গেল কাকু আজ আমাদের বাড়িতে রাত্রিবাস করবে। সেইসঙ্গে আমার আর কাকুর সম্মিলিত আবদার মত রাতের মেনুও ঠিক- খিচুড়ি, ডিমভাজা আর মাছের চপ।

তারপরের কয়েকটা ঘণ্টা যেন কিভাবে স্বপ্নের মত কেটে গেল। গান-গল্প-আড্ডা কিছুই বাদ রইল না। কাকু তো ছিলই, সাথে আবার ধরতাইয়ের জন্য আসরে যোগ দিল বাবা। পুরনো স্মৃতির ঝাঁপি থেকে বেরোতে লাগল একের পর এক কাহিনী। এমন মায়াময় আবহের প্রভাবে এত যে রাশভারী মা, সবার পীড়াপীড়িতে সেও বাধ্য হয়ে তিনখানা গান শোনালো। কতযুগ পরে মাকে গাইতে শুনলাম! কোকিলকণ্ঠী নাম মায়ের সার্থক, সেটা ভাবতে ভাবতেই অবশ্য আবার সেই গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে চলে গেল রাতের রান্নার তদারকি করতে। প্রমত্ত হুল্লোড়ের মধ্যে আগমন গরমাগরম ধোঁয়াওঠা খিচুড়িসহ হরেক পদের, বর্ষার দিনে মহাভোজে মেতে উঠলাম আমরা।
আহারান্তে কাকুর সাথে বসে গল্প করছি, বন্ধ জানলার ফাঁক গলে আসা বৃষ্টির ছাঁটেই মালুম বাইরে কি দুর্যোগ চলছে। রাস্তাঘাট শুনশান, আশেপাশের প্রায় সবকটা বাড়ির আলো নেভানো। গুটিকয় যে ঘরগুলো থেকে রাতবাতির আভাস বেরিয়ে এখনও কোনওমতে সভ্যতার জানান দিচ্ছে আমার এই ছোট্ট একচিলতে বেডরুম তারমধ্যে একটা। খাটে আধশোয়া হয়ে দু’জনে, মন আর দৃষ্টি পড়ে বাইরের তাণ্ডবের দিকে। বাবা-মা আগেই ঘুমোতে চলে গেছে, আমারও দু’চোখের পাতা ক্রমশ ঢুলুঢুলু। কাকু অবশ্য পুরোমাত্রায় সজাগ, বোধহয় সারারাতই গল্প করে কাটিয়ে দিতে পারবে।
কখন জানি না চোখ লেগে গিয়েছিল, হঠাৎ ঠেলা খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছি। ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?’, আবার সেই দিলখোলা হাসি। একটু লজ্জাই পেলাম। কাকু ভোরবেলা ঐ অমানুষিক জার্নি করে ফিরে এসে সারাদিন অফিস করে বহাল তবিয়তে জেগে রয়েছে, আর আমি কিনা আঠারোর সদ্যযুবা সারাদিন বাড়িতে শুয়েবসে থেকে এগারোটা বাজতে না বাজতেই...
অস্বস্তিটা কাটাতে কাকুই সাহায্য করল।
‘তোর কলেজ কবে খুলছে পাপাই?’
‘অ্যাডমিশন তো সামনের মাসে, তার এক সপ্তাহের মধ্যেই...’
‘তবে তো হয়ে এল, অ্যাঁ! এবারে শুধু ক্লাসবাঙ্ক আর গার্লফ্রেণ্ডদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া’
কোনওমতে হাসি চাপলাম। আমি আর ক্লাসবাঙ্ক, তায় গার্লফ্রেণ্ড! সুমাত্রা থেকে আসছো, না মঙ্গলগ্রহ? আজ অবধি কোনও মেয়ের সাথে কথা বলা দূরস্থান, সামনাসামনি চোখ তুলে তাকিয়েছি কিনা সন্দেহ! কাকুকে সে কথা বলতে প্রায় আকাশ থেকে পড়ে।
‘বলিস কিরে! এখনও কারও সাথে ভাব হয়নি?’
‘ওটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে কাকু, আপাতত কলেজে গিয়ে কথা বলতে পারব এটুকুই আশা করছি’
‘দুর ব্যাটা শুধু কথা বলে কি হবে... তোদের স্কুলে মেয়েরা পড়তো না?’
‘নাঃ, অলবয়েজ, একেবারে মরুভূমি’
‘হুম্*ম্*, আর কোচিং ক্লাসে? তুই তো অনেক জায়গায় পড়তে যেতিস?’
‘সেখানে অবশ্য অনেকে ছিল, তবে ঐ যে বললাম, কথা হয়নি কারুর সাথে’
‘কেন, মেয়েরা কি রাইনো না ডাইনোসরাস? কাছে গেলে গিলে ফেলবে?’
অপ্রস্তুত হয়ে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে নিতে হল। আমি যে একেবারেই ল্যাদোস মাল সেতো আর কাকু জানেনা। ভুরু কুঁচকে দেখি কিসব ভাবছে। একটু থেমে বেশ কিন্তু-কিন্তু করে এমন একটা প্রশ্ন করল যার জন্য একেবারেই তৈরী ছিলাম না।
‘তোর কোনও প্রবলেম নেই তো রে?’
‘প্রবলেম বলতে?’
‘এই... মানে কিছুই নয়, ধর আজকাল যেমন দেখায়... হয়তো মেয়েদের জায়গায় ছেলেদের বেশি ভাল লাগে, সেরকম...’
ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মত লাফিয়ে উঠেছি। কাকু শেষটায় আমায় গে ভাবছে!
‘আরে দুর কিযে বলো তুমি! ওসব কিচ্ছু না’
মুখের কথায় নাহোক, অমন প্রতিক্রিয়ার জন্যই বুঝি কাকু একটু আশ্বস্ত হল। গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসছে। তারপরেই প্রতিপ্রশ্নঃ
‘কোচিং ক্লাসের কাউকে ভাল লাগে?’
‘ভাল লাগে বলতে তেমন কিছু তো...’
‘আরে গাধা এমন কেউ নেই যাকে ভেবে হ্যাণ্ডেল মারিস?’ অধৈর্যস্বরে ধমক ভেসে এল। এবার আমার বিষম খাওয়ার পালা। এসব কি বলছে কাকু? নেহাত অপরিপক্ব নই যে কথাটার তাৎপর্য বুঝবনা। আমতাআমতা করতে থাকি, ‘না মানে...’
‘দুর তোর দ্বারা কিস্*সু হবেনা! ভাইপো হয়ে শেষে কিনা কাকুর নাম ডোবাবি? এবয়সে তো আমি অলরেডি একজনকে লাগিয়ে...’ চট করে একবার দরজার দিকে দেখে নিল কাকু, কি যেন ভাবছে। কয়েকমুহূর্ত পরে বোমাটা ফাটলো, ‘দেখি প্যাণ্টটা খোল’
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও এতটা চমকে উঠতাম না। হাঁ করে নির্বাক তাকিয়ে আছি! কাকু কিন্তু নির্বিকার। আবার তাড়া লাগালো, ‘কি রে খোল?’
‘না মানে কিজন্য...’
বেজায় ঘাবড়ে গেছি দেখে কাকু আশ্বস্ত করেছে, ‘ভয় নেই, তোকে একটু শিখিয়েপড়িয়ে দিই। এই দ্যাখ আমিও খুলছি’
কি ঘটছে ভালমত হৃদয়ঙ্গম করার আগেই দেখি কাকুর পায়জামাটা খাটের ওপরে গোটানো, আর দু’পায়ের মাঝে ঝুলছে একটা ছোটোখাটো দানব! এটা কি বস্তু? সব ছেলেদেরই থাকে? কই আমার তো এরকম নেই! নিজের লিলিপুটটার কথা ভেবে আপনা থেকেই কেমন গুটিয়ে যাচ্ছিলাম, কাকুর তাড়া খেয়ে খুব আস্তে নিজের শর্টসটা হাঁটুর নীচে চালান করতে হল। সদ্য সাবালকত্ব প্রাপ্ত আমার পৌরুষ যেন লজ্জায় মাথা আরও নুইয়ে রেখেছে ঐ দানবীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে। আলেকজাণ্ডারের সামনে পুরু তবু নিজের আত্মসম্মান বাঁচাতে পেরেছিলেন, আমি কোথায় লুকোবো নিজেকে? মরমে মরে যেতে থাকি, নিজেকে পুরুষমানুষ ভাবতেও এখন সংকোচ হচ্ছে।
‘আরে চাপ খেয়ে গেলি নাকি? দুর পাগল, ঘাবড়ানোর কিছু নেই... তোরও বড় হবে, শুধু একটু প্র্যাকটিস দরকার।’ কাকুর বরাভয়ে কতটা স্বস্তি পেলাম জানিনা, তবে জড়তাটা একটু হলেও কাটল।
‘দ্যাখ আমি যেমন বলব সেইমত করবি। ডানহাতের মুঠোর মধ্যে এটাকে এইভাবে নে, নিয়েছিস? এবারে তোর কোচিংয়ের সবথেকে সেক্সি মেয়েটার কথা ভাব... ভাব আর এটাকে এইভাবে উপরনীচ করতে থাক’, কাকুর শিরাওঠা মুঠিটা ঠিক পিস্টনের মত ওঠানামা করছে। বাধ্য হয়ে আমিও তাই করি। ফিজিক্স টিউশনের শিঞ্জিনীর কথাই প্রথমে মনে আসে। পাতলা ঠোঁটে চটুল ইশারা, স্টেপকাট চুল, অতলান্তিক দু’টো চোখ। মাঝেমাঝে সেই গভীরদৃষ্টিতে হাল্কা করে ঝাড়ি মারত। মেয়েটার চোখের তারায় কি রহস্য লুকিয়ে কে জানে? ভাবতে ভাবতে হাতের গতি বৃদ্ধি পায়... আঃ, দারুণ সুখ তো ব্যাপারটায়! সত্যিই কাকু লাজবাব।
আরামে কতক্ষণ ধরে চোখ বুজে নিজেকে মেহন করেছি জানিনা। লিলিপুট এখন বেশ বড় আকার ধারণ করেছে, কল্পনাতেই ছিলনা আমারও এমন হতে পারে। মুগ্ধনয়নে নিজের উত্থান দেখতে দেখতে একঝলক কাকুর দিকে দৃষ্টি যেতেই চক্ষুস্থির। উরিবাবা! এটা কি? কাকুও বন্ধচোখে নিজেকে তীব্রগতিতে পেষণ করছে, কিন্তু হাতের মুষলটা যে একটু আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ! কি অসামান্য তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-আয়তন, আবিষ্ট হয়ে দেখতে থাকি। কার ধ্যান করছে কাকু?
ভাবতে-না-ভাবতেই চমকে উঠেছি। পর্দাটা হঠাৎ নড়ে উঠল মনে হল! যেন একটা ছায়ার আভাস। সর্বনাশ, ওরা কেউ উঠে পড়ল নাকি? আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ, হাতের যন্ত্র মুহূর্তেই এতটুকু। খানিক আগের সুখাবেশ কোথায় উধাও, অজানা ভয় গ্রাস করে নিয়েছে আপাদমস্তক। এই অবস্থায় মা যদি দেখে তো খেল খতম, বৃষ্টির মধ্যেই সোজা বাড়ির বাইরে বের করে দেবে। ইষ্টনাম জপ করা ছাড়া আর...
কাকুর অবশ্য এদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই, একমনে কি যেন ভাবছে আর চোখ বুজে বিড়বিড় করতে করতে আগুপিছু করছে নিজের পুংসত্তা। সভয়ে চোখ আবার চলে গেছে দরজার দিকে। পর্দাটা এখনও অল্প নড়ছে।
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষার পরে যা-থাকে-কপালে ভেবে উঠে গিয়েছি সশঙ্ক পায়ে। কাঁপাহাতে পর্দাটা সরালাম। কই, কেউ তো নেই! তবে কি আমারই মনের ভুল? তাই হবে, যেমন উথালপাথাল হাওয়া, তাতেই বোধহয়... সুপ্ত অপরাধবোধ এইভাবে বেরিয়ে এসেছে।
আমার ছন্দপতন বুঝি কাকুর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে, চোখ খুলে আমাকে দরজার কাছে দেখে রীতিমত অবাক, ‘কিরে, ওখানে কি করছিস?’
‘না হঠাৎ পর্দাটা কেমন কেঁপে উঠল সেটাই দেখতে...’
‘দুর বোকা’, আবারও সেই দরাজ অট্টহাস্য, ‘এত ভয় পাচ্ছিস কেন? সুশীলদা তো পড়লেই নাক ডাকায়, আর আমি আছি যখন বৌদি নিশ্চয়ই এত রাতে আমাদের বিরক্ত করতে আসবেনা!’
সেটা আমিও জানি, তবে ভয় আর কবে যুক্তি মেনেছে। এইমুহূর্তে অবশ্য সেসব বলা অর্থহীন। গুটিগুটি পায়ে আবার খাটে এসে বসি। শর্টস পরে নিয়েছি। আমেজটা কেটে গেছে, এখন তৈলঙ্গস্বামী হয়ে কাজ নেই...
কাকু সমস্তটাই লক্ষ্য করল। ব্যাপার বুঝে নিজেও নগ্নতা ঢেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ‘ঘুমো তবে, আমি আসি... আর যেটা শেখালাম, রোজ রাতে মনে করে কিন্তু!’
গেস্টরুমের দরজাবন্ধের আওয়াজ পেলাম। উত্তেজনাটা থিতিয়ে আসতে দু’চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসছে। জানলার ফাঁক দিয়ে সোডিয়াম ভেপারের আলোতে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত মিছিল দেখতে দেখতে কখন নিদ্রার দেশে তলিয়ে গিয়েছি টেরও পাইনি।




ঘুম ভাঙল একরাশ অস্বস্তিসমেত।
রাত কত বোঝার উপায় নেই। রাস্তার বাতিস্তম্ভের কাচে জমে থাকা জলবিন্দুদের ভেদ করে আসা আবছা আলোয় ঠাহর হল বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সবেগে পড়ে চললেও সেই চরাচরভাসানো সর্বগ্রাসী রূপ এখন স্তিমিত। দেওয়ালঘড়িটা দেখতে পাচ্ছিনা, এত অন্ধকার! খাটে শুয়ে এপাশওপাশ করতেই বুঝলাম সমস্যাটা, প্রকৃতির ডাক এসেছে! স্বাভাবিক, রোজ ঘুমোতে যাওয়ার আগে হাল্কা হওয়া অভ্যাস, আর আজ কাকুর পাল্লায় পড়ে...
একটানা অবিরাম বারিপাতে চারিদিকে কেমন ঝাপসা কুয়াশার আস্তরণ, কয়েকহাত দূরের জিনিষও দেখা যায়না। বর্ষণক্লান্ত বাতাসে মৃদু হিমেল ভাব। শুধুমাত্র শর্টস পড়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনওমতে টয়লেটের দিকে গেলাম। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত করে তবে শান্তি।
নিকষকালো আঁধারের মধ্যে ফিরছি, খেয়াল হল গেস্টরুমের দরজাটা আধাখোলা। নিতান্ত কৌতূহলবশেই উঁকি দিলাম, একি! অতীশকাকু তো বিছানায় নেই! গেল কোথায় লোকটা? এই মাঝরাত্তিরে ভিজতে বেরিয়ে গেল নাকি? যা খ্যাপাটে মানুষ, বলা যায়না... কিন্তু এমন বৃষ্টির মধ্যে খুঁজতে বেরোনো আমার পক্ষে অসম্ভব। অথচ সিঁড়ির দরজাও ভেতর থেকে বন্ধই মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুত প্রহেলিকা!
গোটা করিডরটা যেন জমাট তরল আঁধারে ডুবে রয়েছে, নিজের হাতপাগুলোও চোখে পড়েনা। আচ্ছা এত অন্ধকার তো হওয়ার কথা নয়। বাবা-মায়ের ঘরের নাইটল্যাম্প সারারাতই জ্বলে, সেই আলোর আভাটাই বা কোথায়?
ভূতগ্রস্তের মত পায়ে-পায়ে মাস্টার বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। দরজার কবাটদু’টো হাট করে খোলা, পর্দার আবরণের জন্য ভিতরের কিছু দেখা না গেলেও এটুকু বোঝা যায় ঘরের মধ্যে একইরকম নীরন্ধ্র অন্ধকার।
বারিধারার তেজ কমলেও কমেনি হাওয়ার দাপট। উথালপাথাল বাতাসে পর্দাটা ভীষণভাবে দুলছে, আছাড়িপিছাড়ি যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। যেন কারোর হাতছানি।
নিশিতে পাওয়া মানুষের মত এগিয়ে গেলাম। কি এক অদৃশ্য সম্মোহনী চৌম্বকশক্তি টেনে নিল তার অন্দরে।
ভিতরটা বুঝি আরেকপোঁচ গাঢ় কালো রঙের চাদরে মোড়া। বুকের মধ্যেটা কেমন ঢিবঢিব করছে। হাতড়ে হাতড়ে কিছুদূর এগোতেই সামনে ডিভানটা পড়ল। সচরাচর খালি থাকে, এখন নেই। ওঃ, কাকু তবে এখানে এসে শুয়েছে। যাক তাহলে আর বাইরে বেরিয়ে খুঁজতে হবেনা। কিন্তু, কিন্তু... কাকুকে কেমন বেঁটে লাগছে না? এমনি খাটেই তার পা আঁটেনা এত লম্বা, আর এই স্বল্পপরিসরে কেমন করে...
উত্তরটা পেতে কয়েক সেকেণ্ডও লাগলোনা। অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে রূপোলি ঝিলিক বলে দিল এই ব্যক্তি পঞ্চাশ-ছুঁইছুঁই, আমার বাবা। বাবা এখানে কি করছে? জবাব পেতে প্রতিবর্তী-প্রেরণায় খাটের দিকে ঘুরতেই কিসে একটা পা জড়িয়ে মাটিতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনওক্রমে টাল সামলে দাঁড়াতেই মাথার ভিতর প্রবল ঝটকা। মাটিতে কি পড়ে আছে দেখার অবকাশ নেই, দৃষ্টি এখন খাটের উপর। ওপাশের দেওয়ালের কাছে এক দীর্ঘদেহী অবয়ব, অনুমান করতে কষ্ট হয়না কে, আর এদিকে আমার পাশটায় শুয়ে রয়েছে মা। বোজা চোখদু’টোর পাতায় কি এক নিশ্চিন্তি লেগে। সম্ভবত অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
এই অবাস্তব দৃশ্যপটকেও ছাপিয়ে কি একটা অসঙ্গতি যেন চোখে লাগছিল, ঠিক ধরতে পারছিলামনা। খাটের আরেকটু কাছে এগোনোর উপক্রম করতে আবার পায়ে কি জড়িয়ে গেল। তবে এবারে আর পড়ে যাইনি, ভারসাম্য বজায় রেখে নীচু হয়ে হাতে তুলতেই পরিষ্কার হল ওগুলো কি।
ঠিক সেই অমোঘ মুহূর্তটিতে পর্জন্যদেবের বজ্রের ঝলসানিতে আলোকিত হল সমগ্র দিকচক্রবাল। ঘরের ভিতরে পরিপাটিভাবে বিছানো রাত্রির ক্যানভাস সে প্রচণ্ড আলোর অভিঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। অবশ্য, এক পলকের জন্য। তারপরেই সব আবার আগের মত।
গুরুগুরু শব্দে মত্ত প্রকৃতির জান্তব উল্লাস ক্ষীণ হয়ে আসার আগেই আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। বুকের কন্দরে হাতুড়িপেটার প্রবল আওয়াজ। দুর্বল মুঠিতে ধরা অতিপরিচিত নাইটি-হাউসকোট।
ফুটখানেক দূরে খাটের উপর শায়িতা আমার জন্মদাত্রী। সম্পূর্ণ নগ্ন!
কতক্ষণ ঐ ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল নেই, সমস্ত বাহ্যচেতনা লোপ পেয়েছিল। একটুএকটু করে সম্বিৎ ফিরে আসতে টের পেলাম... ভয় নয়, লজ্জা-দুঃখ-রাগ-ঘৃণা কিচ্ছু নয়, আমার অন্তর্লোকে ঠিকরে বেরোচ্ছে দুর্নিবার কৌতূহল। এক অদম্য আগ্রহ।
সেই আগ্রহে ভর দিয়েই আরো এগিয়ে গেলাম খাটের ঠিক পাশটায়। নিশ্চিন্ত নিদ্রার সঙ্গতে ধারাবাহিক লয়ে বুকের মৃদু ওঠাপড়া। কোমর ছাপিয়ে যাওয়া চুল মায়ের, খুলে রাখলে ঘরের আলো প্রতিফলিত হয়ে বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মেঘের মত কেশভার ইতস্তত ছড়ানো বুকের উচ্চতায়, বাহুমূলে, নাভিতে। যেন এক উন্মত্ত পাহাড়ি নদী বহুধারায় শতধাবিভক্ত হয়ে পৌঁছে গেছে বিভিন্ন দেশে। কখনও সমতলের বুক চিরে, বা দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের অহমিকা চূর্ণ করে। শ্যামলা ত্বকের চালচিত্রে ঘনকৃষ্ণ চুলের কি অপূর্ব সহাবস্থান!
হ্যাঁ, আমার মা শ্যামবর্ণা। তপ্তকাঞ্চনারা হয়তো উন্নাসিক সুরে বলবেন ‘ডাস্কি!’ যেমন “কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক”। কবি যদিও দেখেছেন “তার কালো হরিণ চোখ”।
সেই চোখের তারায় কোন স্বপ্ন খেলা করে বেড়াচ্ছে আমি জানিনা। জানিনা এইমুহূর্তে কি করছি, জানিনা সামনে যা ঘটছে তা বাস্তব কিনা। নিষিদ্ধ এক জিজ্ঞাসার তাড়নায় কম্পিত হাতেরা অতিযত্নে দু’পাশে সরিয়ে দিল একসমুদ্র চুলেদের।
আশৈশব এই রমণীকে চিনি। এর কোলেপিঠেই বড় হয়েছি, কিশোরবেলার আগে অবধি আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে থাকতাম তার গায়ে। কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি এ নারীর বক্ষদেশ এত বিস্তৃত, এত বিপুল! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে আপনা থেকে, সভয়ে তাকিয়ে রয়েছে বিস্মিত দুইচোখ। কোনও রক্তমাংসের মানবীর বুক এত বড় হতে পারে? ভরাবর্ষার সুপক্ব তালকে অনায়াসে লজ্জা দেবে... এতটাই সুগোল, পুরুষ্টু, নিটোল।
তৃষ্ণার্ত মরুপথিককে পাত্রভরা মধু দিলে সে তার সুবিচার করতে পারেনা। আমার দশাও তথৈবচ। এই অসামান্য নারীসৌন্দর্যের কদর করব, এমন পৌরুষ কোথায়? বাঁশপাতার মত কাঁপতে কাঁপতে ভীরু হাতটা সন্তর্পণে ছোঁয়ালাম একসময়ে যা আমার জীবনের রসদ জোগাতো সেই মধুভাণ্ডে। আঃ, এত নরম যে দেবে গেল অনেকখানি। নারীমাত্রেই বুঝি কোমল? যে মহিলা দিবারাত্র কঠোর অনুশাসনে বেঁধে রাখে আমার প্রতিটি কার্যকলাপ, তার অন্তঃস্থল যে এমন পেলব কে জানত! যৌবনের দোরগোড়ায় পুরুষশরীর যথেষ্টই পরিণত, তবু হাতের তালুতে স্তনের অর্ধেকও আঁটছেনা। অনির্বচনীয় অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মন, আরও প্রগাঢ় সুখের আকাঙ্ক্ষায় প্রবলতর চাপ দিলাম। কে যেন ভিতর থেকে অনবরত ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে নির্মম পেষণের।
সর্বনাশ, মা নড়াচড়া করতে শুরু করেছে যে! মুহূর্তের ভুলে একি বিপদ ডেকে আনলাম! প্রচণ্ড ভয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়েছি, খাটের নীচে নিজের শরীরটাকে লুকোনোর চেষ্টা করছি যথাসম্ভব। হা ভগবান, মা উঠে পড়লে কি জবাব দেব?
একটা গোটা মিনিট, বা অনন্তকাল কেটে গেল বিপদের আশঙ্কায়। বুকের মধ্যে অনবরত ড্রাম পিটছে। তারইমধ্যে খেয়াল হল হাতের তালুতে কি এক আলাদা স্পর্শের স্মৃতি। যেন ছুঁচলো কিছু বিঁধছিল ওখানে!
বহুযুগের ওপারে আবার মাথা তুলে দাঁড়ালাম অন্ধকারের মধ্যে। অবশ্য তরল আঁধারে চোখ অনেকটাই সয়ে গেছে। সেই স্বচ্ছদৃষ্টিতে দেখলাম মা এখনও ঘুমিয়ে, তবে দৃশ্যপট কিছুটা পরিবর্তিত। মা শুয়ে আছে ওপাশে ফিরে, একটা হাত আলগোছে পড়ে কাকুর চওড়া ছাতির উপর, ভারী বুকজোড়া মৃদুভাবে পিষ্ট হচ্ছে পুরুষালি বাইসেপসে।
হঠাৎই নিজেকে কেমন বঞ্চিত মনে হল। কি এক নিষ্ফলা ক্ষোভ চাগিয়ে উঠছে বুকের মধ্যে। অধিকার করে নিচ্ছে আমার মস্তিষ্ক-হৃদয়-সমগ্র সত্তা। আচ্ছন্ন অবস্থায় টের পেলাম ক্ষোভ ক্রমে বদলে গেছে ঈর্ষাতে। এই নারীর জঠর আমার প্রথম বাসস্থান, এর স্তনেই মিটেছে প্রথম ক্ষুধা। তবে এই মুহূর্তে কেন আমার কোনও অধিকার নেই এই মানবীতে? কেন সে অন্যপুরুষের কণ্ঠলগ্না?
অবাস্তব যুক্তিহীন আক্রোশে ক্ষতবিক্ষত মন গুমরোতে থাকে।
কাকু তবে এই শৃঙ্গগুলোও জয় করে নিল?
অক্ষম জিজ্ঞাসার মাঝে চোখ পড়েছে নীচের দিকে, তৎক্ষণাৎ বুকের ভিতর ছোটখাটো বিস্ফোরণ। মায়ের সঙ্গীতচর্চার স্মারকরূপে আজও যেটা বসার ঘরে শোভা পায়, অবিকল সেই তানপুরার খোলের মত অবহেলায় শুয়ে থাকা উন্মুক্ত গুরুনিতম্ব।
স্মৃতির অতল থেকে ভেসে ওঠা একটা ঘটনা বিদ্যুচ্চমকের মত মনে পড়ে গেল। স্কুল থেকে মা-ই নিয়মিত নিয়ে আসত। বাসস্ট্যাণ্ডের অনতিদূরে চায়ের দোকানে গুলতানি করা কিছু উঠতি যুবকের অশ্লীল টিটকিরির মাঝে ছিটকে আসা একটা শব্দ, তৎক্ষণাৎ মায়ের কর্ণমূল লাল হয়ে যাওয়া। মনের খাতায় আজও স্পষ্ট পড়া যায় সেই বিশেষণ। ‘ডবকা’!
ভাবতে-ভাবতে কখন যেন ঐ গুপ্তদ্বারের দিকে এগিয়ে গিয়েছি। মুখটা কাছে নিয়ে যেতে আচমকা এক ঝাঁঝালো গন্ধে বেসামাল! ক্রমশ রহস্যটা পরিষ্কার হচ্ছে। তাও নিশ্চিত হতে নাকটা একেবারে দুই উরুসন্ধির সংযোগস্থলের কাছে নামাতেই...
আঠারোটা বসন্ত পেরিয়ে বীর্যের গন্ধ নির্ভুলভাবে চিনতে পারি!
এতক্ষণে একটু একটু করে ঘনীভূত সংশয় এবার নিশ্চিত প্রত্যয়ের আকার নিল। ঈর্ষাটা গাঢ় হওয়ার সাথেই অন্য একটা তীব্রগন্ধের আকর্ষণে অস্থির হয়ে উঠলাম। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের অপেক্ষা, গন্ধের উৎসমুখে স্থাপিত করেছি ঘ্রাণেন্দ্রিয়। বুকভরে নিচ্ছি গুহ্যদ্বারের নিষিদ্ধ সুবাস। আঃ, এখানেও কি তৃপ্তি! অস্থির উত্তেজনায় ছটফটিয়ে উঠে গোপনগুহার মধ্যে জিভটা প্রবেশ করালাম। লেহন করছি বারেবারে।
আবারও ঝোঁকের মাথায় অসাবধান হয়ে পড়া, আবারও মায়ের নড়েচড়ে ওঠা। এবারে অস্ফুটে বিরক্তিসূচক প্রতিক্রিয়াসহ। আগের মতই গিয়ে সেঁধো্লাম খাটের নীচের অন্তরালে। সুযোগের অপেক্ষায়। বেশ বুঝতে পারছি নেশা ধরে গেছে।
নেশার আহ্বানেই বোধহয় এবার অধৈর্য হয়ে তাড়তাড়ি উঠতে হল। আর উঠতেই চমৎকৃত! মা আবারও আমার দিকে ফিরেছে, তবে তেরছাভাবে। একহাত মাথার নীচে আড়াআড়িভাবে রেখে। ঈষৎ বক্র দেহভঙ্গিমার ফলে দুই ভঙ্গিল পর্বত আরও মোহময়ীভঙ্গিতে উঁচিয়ে। চিবুকের অনবদ্য ডৌলে, গ্রীবার মরালী বঙ্কিমতায় জাত-মৃৎশিল্পীর স্বাক্ষর। কপালের টিপটা খানিক ধেবড়ে গিয়ে ঢলঢলে মুখখানা আরও আকর্ষণীয়া, ঠিক যেন কুমোরবাড়ির নির্মীয়মাণ দুর্গাপ্রতিমা। ক্বচিৎকদাচিৎ কানে আসা মেয়েলিআড্ডার অংশবিশেষে মায়ের প্রতি পিসিদের ঈর্ষাকাতর প্রশংসাবাক্যগুলো মনে পড়ল।
এই মানবীকে চিরকাল আটপৌরে বেশেই দেখে এসেছি। মাতৃসত্তা থেকে নারীসত্তা কোনওদিনও পৃথকভাবে ধরা পড়েনি। আদর-শাসন-স্নেহের আড়াল সযত্নে ঢাকা দিয়েছে রূপের ছটা, যৌবনের দীপ্তি। মমতাময়ীর মোহিনীমূর্তি আজ হঠাৎ সামনে এসে আমাকেও যেন সাবালক করে দিয়ে গেল। অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকি অপলকে। কে বলবে মা চল্লিশের কোঠায় পা দিয়েছে! নিদ্রামগ্ন এই রমণীকে অনায়াসে ত্রিশ-বত্রিশ বলে ভ্রম হতে পারে।
নিজের অগোচরেই কখন আমার হাতদু’টো আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সহসা অনুভব করলাম তারা আরেকটু সাহসী হয়ে রীতিমত ব্যস্ত ঐ মায়াবী নারীর অলীক-সুন্দর বক্ষদেশ দলন-মর্দনে। আরও প্রত্যাশার আকঙ্ক্ষায় মুখ নামিয়ে দিয়েছি, কোমল-কবোষ্ণ স্তনের উপর পড়ছে আত্মজের নিঃশ্বাসের হল্কা। প্রাণভরে নিতে থাকি মায়ের বুকের স্বর্গীয় ঘ্রাণ। বাদলা দিনের কদমফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে যাই। স্বপ্নাবিষ্ট দুই ঠোঁট বিনাবাধায় এগিয়ে যায় উন্মুখ স্তনবৃন্তের দিকে। খানিক আগের রমণ-আবেশে জেগে থাকা বোঁটাদের থেকে প্রাণরস আহরণ করতে থাকি। আঃ, কি সুখ সুধাপানে!
মুহূর্তের প্ররোচনায় হঠাৎই দংশন করেছি পেলব ত্বকে। ঘুমের মধ্যেও মা ব্যথায় কাতরে উঠেছে। আর নয়, অনর্থ ঘটে যেতে পারে। ত্রস্তপায়ে ঘর থেকে একদৌড়ে সোজা বাথরুমে। হ্যাঁচকা টানে খুলে গেল শর্টস, পৌরুষের সঞ্চিত গ্লানি ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে। আজই কাকুর কাছে শেখা।
উঃ মাগো!
কে জানত জন্মদায়িনীকে ভেবেই হবে যৌবনের প্রথম উন্মেষ?




গভীররাত। আনন্দবাড়ির নিরবচ্ছিন্ন কোলাহল থেমে এখন বোধহয় সবাই ঘুমের দেশে। একা আমি জেগে আছি বিনিদ্র চোখে।
সহসা কপালে চেনা স্পর্শ। তাকাতেই দেখি, মা।
‘ঘুমোসনি পাপাই?’
নির্নিমেষ চেয়ে থাকি এই অসামান্যা নারীর দিকে। কি ধাতুতে গড়া সে? জীবনে একটিবারের জন্যেও দেখিনি তাকে স্বামী-সন্তান-সংসারের প্রতি মনোযোগ হারাতে। নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলি দিয়েও তাদের প্রতি বরাবর কর্তব্যে অবিচল, একনিষ্ঠ। জীবন আজ প্রৌঢ়ত্বের সীমান্তে, তবুও শত ব্যস্ততার মাঝে নবপরিণীতাকে আগলে রেখেছিল সারাটাদিন।
শ্রান্তদেহে এখন সে এসেছে নাড়ির টানে। স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে।
চুলে বিলি কাটতে কাটতে ব্যাখ্যাতীত এক চাহনিতে তাকিয়ে আছে মা। কি দেখছ এমন করে? কাল থেকে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আরেক নারীতে বর্তাবে... তাই বুঝি তোমার চোখে লুকনো বেদনা?
হঠাৎ একদলা আবেগ গলার কাছটায় আটকে আসে। বিনা বাক্যব্যয়ে জড়িয়ে ধরি মাকে। কি করে বোঝাবো, তোমার যে কোনও বিকল্প নেই!
পরম মমতায় সে আমার মাথাটা টেনে নেয় নিজের বুকে। এই তো আমার আঁতুড়, আমার প্রথম খেলাঘর।
অনেকগুলো বছর লহমায় পিছিয়ে গেল। আবারও এক পিপাসার্ত শিশু আমি, সদ্যোজাত। আকুল হয়ে গন্ধ নিই।
আমার যৌবনের প্রথম কদমফুল।

______________________________
 

Top